নানা ও মামার সঙ্গে চশমা কিনতে হালিশহরের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন মেহেরীন মাহবুব সাদিয়া (২০)। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ থেকে চশমা কিনে নানার হাত ধরে বাসায় ফিরছিলেন। ফেরার পথে হঠাৎ পা পিছলে নালায় পড়ে যান। তখন সময় রাত ১০টা। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে রাত ৩টায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। করুণ এই মৃত্যুর শিকার সাদিয়া লেখাপড়া করতেন চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।
সোমবার রাতে নানা ও মামার সঙ্গে চশমা কিনতে গিয়েছিলেন আগ্রাবাদ এলাকায়। চশমা কিনে ফেরার পথে আগ্রাবাদের শেখ মুজিব সড়কের নবী টাওয়ারের পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন সত্তরোর্ধ্ব নানা হাজি জামালের হাত ধরে। পাশেই ছিল নালা। আচমকা পা পিছলে পড়ে যান নালায়। মুহূর্তে নানা চিৎকার করে ওঠেন—সাদিয়া পড়ে গেছে। পাশে থাকা মামা জাকির হোসেন নালায় ঝাঁপ দেন ভাগ্নিকে উদ্ধারে। কিন্তু নালায় প্রবল স্রোত থাকায় সব চেষ্টা বিফল হয়। নালার পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে যান সাদিয়া।
এই দুর্ঘটনার খবর পৌঁছে গেলে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস। তারপর শুরু হয় রুদ্ধশ্বাস উদ্ধার অভিযান। রাত ১০টার পর শুরু হওয়া উদ্ধার অভিযান শেষ হয় রাত ৩টার কিছু সময় পর। কাদা-মাটি ও আবর্জনার স্তূপ থেকে সাদিয়ার নিথর দেহ বের করে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার দায়িত্বরত চিকিৎসক সাদিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত সাদিয়ার বাবা মোহাম্মদ আলী হালিশহর বড়পোল এলাকার বাসিন্দা। দুই ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে সাদিয়া বড়। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বড়পোল এলাকায় জানাজা শেষে সাদিয়াকে দাফন করা হয়েছে। এ সময় পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। জানাজায় অংশ নেওয়া হাজারো মানুষকে কাঁদিয়ে সাদিয়া চিরদিনের জন্য আশ্রয় নেন সাড়ে তিন হাত মাটির গভীরে।
কিছুদিন পরপরই নালায় পড়ে প্রাণহানির সংবাদ—এ যেন চট্টগ্রামবাসীর জন্য নিত্য ঘটনা। এর আগে গত ২৫ আগস্ট মুরাদপুর এলাকায় নালায় পড়ে স্রোতের টানে হারিয়ে যান সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমদ। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম মহানগরীর অন্তত ৯০ শতাংশ নালা উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে ধারাবাহিক ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। ২০১৭ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত সাতটি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে উন্মুক্ত এই নালা।
ডবলমুরিং থানার ওসি আবুল কাশেম ভুঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, চশমা কিনে বাসায় ফেরার পথে সাদিয়া পা পিছলে নালায় পড়ে যান। পরে রাত ৩টায় ঘটনাস্থল থেকে ৩০ গজ দূরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়েছে।
উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, সাদিয়া যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানে দুটি নালা। একটি নালা সড়কের পাশে, আনুমানিক ১০ ফুট প্রশস্ত। এই নালার ভেতরে রয়েছে আরেকটি নালা, যেটি দেখা যায় না। সেটিও ১০ ফুট প্রশস্ত। ভেতরের নালায় আবর্জনার ভাগাড়। দুটি ক্রেন এনে স্ল্যাব উঠিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হয়। ১৫ থেকে ২০ ট্রাক আবর্জনা সরানোর পর সাদিয়াকে পাওয়া যায়।
নাতনিকে হারিয়ে বিলাপরত নানা হাজি জামাল বলেন, ‘সাদিয়া আমার হাত ধরেই হাঁটছিল। হঠাৎ নালায় পড়ে গেলে আমি চিৎকার দিই। মুহূর্তে আমার ছেলে নালায় ঝাঁপ দিল। কিন্তু চেষ্টা করেও সাদিয়াকে উদ্ধার করতে পারেনি।’ নানার বিলাপে উপস্থিত লোকজনের চোখ ভিজে যায়।